জমা জলের ভোগান্তি আজকের নয়। বছরের পর বছর ক্যালেন্ডারে পাতা বদলেছে। বদলায়নি পরিস্তিতি। একাধিকবার উদ্যোগও নেওয়া হয় প্রশাসনের তরফে কিন্তু তার নিট ফল যে আদতে শুন্যই, তা নতুন করে বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। গত কয়েক সপ্তাহে বৃষ্টির বাড়বাড়ন্ত, চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ‘ কলকাতা লন্ডন হবে, স্মার্ট হবে ’ ইত্যাদি যে যে প্রতিশ্রুতিতে ভর করে কল্লোলিনী এতদিন মধ্যাহ্নের মধ্যগগনে দাঁড়িয়েছিল তা একটা বিরাট ভাঁওতা। কেন?

২০২২, কলকাতা এনভায়র্নমেন্টাল ইমপ্রুভমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম বা KEIIP। নিকাশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ কলকাতা পুরসভার। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক বা ADB থেকে ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ। রাজ্য দেবে ১৫৩ কোটি টাকা।মৌলালি থেকে পামার বাজার পর্যন্ত পলি সংস্কারের জন্য খরচ করা হবে এই টাকা। ৭৬টি পাম্প বসানো হবে।
২০২২, শহরের ১৪টি ওয়ার্ডের ড্রেনেজ লাইন পরিষ্কার বাবদ ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ পুরসভার।
২০২৩, আমহার্স্ট স্ট্রিটের ঋষিকেশ পার্কে বসবে নতুন পাম্পিং স্টেশন। একবালপুরের নবাব আলি পার্কে, নতুন পাম্পিং স্টেশন চালু। খরচ ৮২ কোটি।
২০২৪, কলকাতার ১২টি ওয়ার্ডে নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়নে খরচ হবে ২,৫০০ কোটি টাকা। (পশ্চিম চৌবাগা, হোসেনপুর, মাদুরদহ, নয়াবাদ, মুকুন্দপুর, গার্ডেনরিচ, জোকা, সরশুনা এবং বেহালা বেশ কিছু অংশ )। পাকা, ঢাকনা দেওয়া নর্দমা তৈরির পাশাপাশি নর্মদা জল পরিশ্রুত করে গঙ্গায় ফেলার জন্য পাঁচটি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তৈরি করা হবে।
২০২৪, নিকাশি ব্যবস্থা উন্নত করতে পাম্পিং স্টেশন সহ লক গেটের জন্য তৈরি হবে ডিজিটাল ম্যাপ। যাতে পাম্পিং স্টেশন এবং লক গেটর অবস্থানের পাশাপাশি কোথায় কত জল জমে আছে, তা সহজেই ডিজিটালি ধরা পড়ে।
এবার আসি, এবছরের কথায়। ২০২৫।
1.মহেশতলায় শুরু খাল সংস্কারের কাজ।
2.জমা জলের সমস্যার সমাধানে নতুন কমিটি গঠন।
3.উত্তর কলকাতার জল সরাতে আমহার্স্ট স্ট্রিটের হৃষিকেশ পার্কে তৈরি হচ্ছে একটি ড্রেনেজ পাম্পিং স্টেশন। অন্যদিকে ক্ষমতা দ্বিগুণ করা হচ্ছে ট্যাংরার পামার বাজার ড্রেনেজ স্টেশনের।
4.বন্দর এলাকায় গার্ডেনরিচের ময়লা ডিপো সহ বেহালা মিন্ট কলোনিতে দুটো পৃথক ড্রেনেজ পাম্পিং স্টেশন নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে।
5.দক্ষিণ শহরতলি এবং বন্দর এলাকার নিকাশি ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট দইঘাট এলাকা। এখানেই রয়েছে টলিনালা এবং হুগলি নদীর সংযোগস্থল। এই জায়গায় একটি ব্যারেজ এবং একটি পৃথক পাম্পিং স্টেশন নির্মাণ হবে।
6.দক্ষিণ কলকাতার পঞ্চাননতলা এবং যোধপুর পার্কের জন্য একটি আলাদা পাম্পিং ড্রেনেজ স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল অনেক আগেই কিন্তু জায়গার অভাবে তা শুরু করা যায়নি। তবে গড়ফার বিবি ওয়ান ক্যানেল সংলগ্ন এলাকায় একটি পাম্পিং স্টেশন করা হচ্ছে যা ঢাকুরিয়ার ব্যাঙ্ক প্লট, লেক গার্ডেন্স এবং যোধপুর পার্কের নিকাশি ব্যবস্থাকে আর উন্নত করবে।
তবে এতো কিছুর পরেও কেন রেহাই মিলছে না জল যন্ত্রণা থেকে। কেন বদল হচ্ছে না পরিস্থিতির?এর উত্তরে গাফিলতির দায়ভার কিছুটা সাধারণ নাগরিকদের ওপরই দিয়েছে কলকাতা পুরসভা। তাঁদের কথায়, গত ১০ বছরে কলকাতার বিভিন্ন ম্যানহোল থেকে প্রায় ১৭ লক্ষ ৪৬ হাজার ৩৫৯ মেট্রিক টন পলি তুলেছে পুরসভা। তারপরেও জমা জলের সমস্যা কমছে না। এর একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ, ড্রেনেজ লাইনে জমে থাকা প্লাস্টিক,বালিশ, ব্যাগ,বোতলের মতো আবর্জনা।

একবার নয় একাধিকবার নিকাশি নালা পরিষ্কার করতে গিয়ে এই সমস্ত আবর্জনা পরিষ্কার করতে হয়েছে পুর কর্মীদের। এখন প্রশ্ন হল এইগুলো আসছে কোথা থেকে! এই সমস্ত আবর্জনাই ম্যানহোল আর নর্দমার সংযোগস্থলে এসে জমা হয়ে ড্রেনেজ ব্যাহত করছে । আবার কখনও খবর আসছে পাম্পিং স্টেশনের পাম্পে প্লাস্টিক ঢুকে পাম্প খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ যতক্ষণ না নিজে থেকে একটু সচেতন হবেন ততক্ষণ অব্দি এই জলযন্ত্রণা থেকে সম্পূর্ণরূপে রেহাই আছে বলে মনে করছেন না কলকাতা পুরসভার আধিকারিকেরা।
প্রসঙ্গত, সাধারণ মানুষের অসচেতনতাই কি স্রেফ দায়ী? যে প্রশ্নের উত্তরগুলি উহ্য থেকে যায়, প্রতিবছর কতবার শহরতলীর নিকাশ নালা এবং খালগুলি পরিষ্কার করা হয়? অন্তত প্রতিবছর বর্ষার আগে নিকাশি নালাগুলির অবস্থান কেমন তা কি আদেও খতিয়ে দেখা হয়? শহরের গুরুত্বপূর্ণ পাম্পিং স্টেশনগুলির দশা কেমন তা নিয়ে বছরে কতবার রিপোর্ট তলব করা হয়? নালাগুলিতে অত্যাধিক ময়লা আবর্জনা ঠেকাতে কোন কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে পুরসভা ?
তর্ক-বিতর্ক, প্রশ্ন-উত্তর থাকবে। সেই সঙ্গে থাকবে জল যন্ত্রণা। এর আগেও প্রশাসন একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে তারপরও অবস্থা থেকে কেবল সাময়িক কিছু স্বস্তি। ফের যেই কে সেই। এ ছবি বদলায় কবে এবার সেটাই দেখার।
0 Comments